হিমালয় কন্যার দেশে
প্রকাশিত হয়েছে : ৪:৫৮:১৪,অপরাহ্ন ০৮ নভেম্বর ২০১৯ | সংবাদটি ৬৫৮ বার পঠিত
তুহিন আহমদ পায়েল 💠
আমার পায়ের নিচে যেনো শর্ষে! হাতে দু’পয়সা জমলেই মন আনচান করে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে। সব সমইয় চেষ্টা করি চেনা পরিবেশের বাহিরে কিছু দেখতে, নতুন মানুষ আর পরিবেশের সাথে পরিচিত হতে। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণই নতুন কিছু প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াই।
প্রতিবার ভ্রমণ করতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছি অনিন্দ্য সুন্দর কিছু নগরীকে। যা হৃদয়-মন জুড়িয়ে যাবার মত। তাই এসব ভ্রমণে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারি হয়েছে অনেকখানি। ভ্রমণের মাধ্যমেই কোন দেশের মানুষ, তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ইত্যাদির সার্বিক রূপ জানা সম্ভব হয়েছে।
এ সামান্য জীবনে কয়েকটি দেশ ঘুরে দেখা হয়েছে। অনেকই তা লেখার মাধ্যমে গভীরভাবে বিশ্লেষণে বাস্তব বিশ্বের রুপকে ফুটিয়ে তোলেন। আমিও চেষ্টা করেছি আমার নিরীক্ষাপ্রবণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে নেপাল দেশকে। প্রথম বারেরমত দুচোখ মেলে দেখেছি ‘হিমালয় কন্যা’ খ্যাত অনিন্দ্যসুন্দর নগরী নেপাল দেশকে। নেপাল দেশটার কথা মনে পরলেই চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে উঠে হিমালয়ান পর্বতমালার অপরূপ সৌন্দর্য্য, নাগরকোট, পোখরার ফেওয়া লেক, আর কারুকার্যময় মন্দির।
কিছুদিন আগে সুযোগ পেতেই ঘুরে এলাম হিমালয়ের পাদদেশের প্রকৃতিকন্যা খ্যাত নেপাল। আমার ফ্লাইট ছিল সকাল ১০.৪০ দিকে, বিমান বাংলাদেশ। সকালে ঘুম থেকে উঠে ৭টার দিকে (সাধারণত ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে ৩ ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে হয়, ব্যাকআপ সময় হাতে রাখার জন্যে) রেডি হয়ে চলে গেলাম ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। লাগেজ নিয়ে চেক-ইন কাউন্টার গিয়ে বোডিং পাস নিয়ে নিলাম। জানালার পাশে সাইড সিট চেয়ে নিলাম। যেন আকাশ থেকে হিমালয় দেখতে দেখতে পৌঁছে যেতে পারি কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
১ ঘন্টা ৪০ মিনিটের উড়ানে পৌঁছে যাই কাঠমান্ডু।যেহেতু আমি ঢাকার নেপাল এম্বেসি থেকে ভিসা নিয়েছি, সেজন্য আমাকে আর অন-এরাইবেল ভিসার লাইনে দাঁড়াতে হলো না। না হলে লাইনে দাঁড়িয়ে ভিসা সংগ্রহ করতে অনেক সময় চলে যেত।
ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সোজা চলে গেলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ইমিগ্রেশন শেষ করে এবার লাগেজ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষার পালা। সব নিয়ম পালন শেষে বিমানবন্দর থেকে বের হতে সময় লেগেছিল ৫০ মিনিটের মত।
বিমানবন্দরের সাথেই প্রিপেইড ট্যাক্সি কাউন্টার। সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে যাই ‘থামেল’ নামক জায়গায়। সেখানেই পর্যটকরা বেশি অবস্থান করেন। অনলাইনে হোটেল বুকিং করে রেখেছিলাম, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলে দিলাম সে হোটেলএ নিয়ে যাবার জন্য। হোটেলের রিসিপশন কাউন্টারে পৌঁছাতে তারা সাদর সম্ভাষণ জানাল।
দুপুর হয়ে গেছে। পেটে ছুঁচোড় দৌঁড় শুরু হয়ে গেছে, তাই খেতে হোটেলের ৮ম তলার ছাদের উপর রেস্টুরেন্ট ফোন করে খাবার অর্ডার দিলাম। পেটপূজা শেষে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে বিকালের আবহ। তাই তাড়াতাড়ি একটু বেরিয়ে পড়লাম, যাতে আশপাশটা একটু ঘুরেফিরে দেখতে পারি। গুগল ম্যাপের সাহায্যে থামেলের ছোট ছোট রাস্তার আশপাশটা ধরে হাঁটা শুরু করলাম।
থামেল হলো কাঠমান্ডুর পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্র। হাজার হাজার হোটেল, স্যুভেনির শপ, হাইকিংয়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, বার যেনো এখানে বসে আছে প্রাণচাঞ্চল্য কি জিনিস, তার আভাস দিতে! রাস্তার পাশে সারি সারি দোকান। ফেরিওয়ালারা নানারকমের পসরা সাজিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার আশায় বসে থাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। থামেল মার্গ হলো এলাকার প্রধান সড়ক, যা নানা রঙের পতাকা দিয়ে সাজানো। এখানে পাওয়া যায় সিংগিং বোলের আওয়াজ আর ধুপধুনোর মনমাতানো গন্ধ।
মান্ডালা স্ট্রিট, থামেলের আরেকটি রাস্তা। যা বইয়ের দোকান, কফি শপের জন্য বিখ্যাত। থামেল থেকে চাইলে যে কেউ গোর্খা ছুরি থেকে শুরু করে সিঙ্গিং বোল, চাদর, মান্ডালা ওয়াল পেইন্ট ও আরো অনেক কিছু কিনতে পারেন।
ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে এক সময় সন্ধ্যা নেমে আসে। তাই আর ওইদিন কোন পর্যটন স্পট ঘুরতে যাইনি। নেপালে রাত ১০ রাত মধ্যেই বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাতে খাবার খেয়ে নিদ্রাদেবীর হাতে নিজেকে সঁপে দিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হোটেলে নাস্তা করে রওনা দেই কাঠমান্ডু শহরের পর্যটন স্পটগুলো দেখার জন্য। হোটেল থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি ডাকি, কিন্তু ভাড়া বেশি চাওয়ায় রিকশায় দরবার স্কয়ারে যাই। নেপালে এসেও রিকশায় চড়ার মজাটা উপভোগ করে নিলাম। কিন্তু দরবার স্কয়ার যে হোটেল থেকে এতো কাছে, তা জানলে হয়তো রিকশাও নিতাম না।
টিকেট সংগ্রহ করে ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করি। এ সময় দেখা হলো আমার সাথে একই ফ্লাইটে যাওয়া কিছু বাংলাদেশি ভাইদের সাথে। তারা একটি কোম্পানির মাধ্যমে ৪২ জনের একটি গ্রুপ ছিল। তাদের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে নিজের মতো ঘুরেফিরে দেখতি থাকি।
কাঠমান্ডুতে পর্যটকদের দেখার কিছু জায়গা হলো দরবার স্কোয়ার, গার্ডেন অব ড্রিমস, বৌদ্ধনাথ স্টুপা, সয়ম্ভূনাথ মন্দির, পশুপতিনাথ মন্দির, নেপালের জাতীয় মিউজিয়ামসহ বিভিন্ন আকর্ষনিয় জায়গা। প্রায় সবগুলো অবস্থানই থামেলের আশেপাশে। যারা প্রথমবার এসেছেন গুগল ম্যাপ দেখে দেখে খুঁজে বের করতে সময় লাগতে পারে, তাই ট্যাক্সি নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন। ভূমিকম্পের কারণে এখন অনেটাই ক্ষতিগ্রস্থ। যা এখন সংস্কারের কাজ চলেছে। উনিশ শতক পর্যন্ত নেপালের রাজা ও তার পরিবারের সদস্যরা এখানেই বসবাস করতেন। জায়গাটি এতোটাই বনেদী এবং ঐতিহ্যের সাক্ষী যে, ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। রাজপ্রাসাদ ছাড়াও ১২ শতকের প্রচুর হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে প্রচুর পায়রা দেখা যায়, যা আলাদা মাধুর্য্য যোগ করে ভ্রমণে।
দরবার স্কয়ারে দেখার মধ্যে রয়েছে সাদা ভৈরব বা সেতো ভৈরব, জগন্নাথ মন্দির, তেলেজু মন্দির, ইন্দ্রপুর মন্দির, মহেন্দ্রশ্বর মন্দির।
দুর্ভাগ্যবশত ২০১৫ সালের তীব্রমাত্রার ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদসহ মন্দিরগুলোর দক্ষিণ দিক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও এর বর্তমানে অবশিষ্ট অংশ দেখেও এর আদি সৌন্দর্যের আন্দাজ করা সম্ভব। সংস্কার কাজের জন্য বর্তমানে দরবার স্কয়ারের টিকেটের মূল্য বাড়লেও আশার কথা সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য তা নাগালের মধ্যেই আছে।
হিন্দুদের পবিত্র ও নামকরা মন্দিরগুলোর মধ্যে নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির সবচেয়ে বিখ্যাত। কথিত আছে, এ মন্দির গড়ে উঠেছে শিবের সেবার জন্য। নেপাল ছাড়াও প্রতি বছর ভারত থেকে অংখ্য মানুষ এখানে শিবের পূজা করার জন্য ছুটে আসেন। এখানে দেখা পাওয়া যায় নানা প্রকৃতির সাধুদের।
সয়ম্ভূনাথ স্তুপ নেপালের বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরগুলোর একটি। তালিকা করলে সয়ম্ভূনাথ থাকবে এক থেকে তিনের মধ্যে। এটি কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে পাহাড়ের চূঁড়ায় অবস্থিত। সেখানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে গুণে গুণে ৩৬৫টি পাথরের তৈরি সিঁড়ি। অবশ্য সিঁড়িতে পা দেবার আগেই নজর পড়বে বানরের দিকে! মন্দির চত্ত্বর ও তার আশেপাশে বানরের লাফালাফি দেখা যাবে, যারা বহুদিন ধরেই এখানে বসবাস করে আসছে। এসব বানরকে নেপালীরা ‘পবিত্র দূত’ বলে মনে করে। তাদের ধারণা বুদ্ধ দেইতী মঞ্জুশ্রীর মাথার উঁকুন থেকে এসব বানরের জন্ম এবং তারা এখানে তার সময়কাল থেকেই রয়েছে।
এ মন্দিরটি নেপালের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর একটি। পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে এর অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। জানা যায়, ২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প তেমন একটা ক্ষতি করতে পারেনি এইস্থানটির। মন্দিরটি অধিকাংশ সময়ই পর্যটকের ভীড়ে ভারি থাকে। তাই সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টাই হলো সয়ম্ভূনাথ মন্দির ঘুরেফিরে দেখার জন্য সবচেয়ে ভাল সময়। মন্দিরের অংশগুলোর মধ্যে বুদ্ধ অমিদেভা পার্ক, পশ্চিমের স্তুপা বা স্তম্ভ, পূর্বের সিঁড়ি অবশ্যদ্রষ্টব্য। প্রবেশ মুখেই টিকেট কাউন্টার রয়েছে মন্দিরটি ঘুরে দেখার জন্য। এর উপর থেকে কাঠমা-ু শহরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়।
সেখান থেকে চলে যাই নেপালের একটি বাজারে। আসানবাজার আসান টোলে বা আসান বাজার হলো নেপালের তাজা শাকসবজি ও ফলের বাজার। বাড়িতে বানানো স্থানীয় পানীয় রাকশি থেকে শুরু করে নানারকম মশলা, স্থানীয় নাম না জানা ফল সমস্ত কিছু এখানে পাওয়া যায়।
এখানে কাঠমান্ডুর বাইরে থেকে রোজ কৃষকরা আসে তাদের পণ্য বিক্রি করতে। লোকাল জিনিস ও মানুষদের কাছ থেকে দেখার জন্য আসান টোলে, শহরের বাইরের সেই সুপার মার্কেটের মতো কাজ করে, যা ভ্রমণে অনন্য মাত্রা যোগ করতে সক্ষম। এগুলো দেখতে দেখতে অনেকটা সময়ই চলে যায়। তারই মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বৃষ্টি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি অনেক সময় ধরে চলতে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর বৃষ্টি থেমে গেলে কিন্তু ঝলমলে রোদের দেখা পেলামনা। খুব খুশি লাগছিলো আবহাওয়া দেখে। কিন্তু ঠান্ডা বাতাসে একটু শীতও লাগছিল।
এবার রওয়ানা হলাম অন্য কোন জায়গা দেখতে । ট্যাক্সি না নেয়ায় অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে। টিকেট কিনে শঙ্করদা পার্কে বসে একটু বিশ্রাম নিলাম। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন একটি নিও-ক্লাসিকাল পার্ক এটি। আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। নেপালের স্থানীয় অনেকেই এ পার্কে ঘুরতে দেখে তা বুঝতে পারলাম। স্থানীয় প্রেমিকযুগলই একটু বেশি বলে মনে হচ্ছিল। সব মিলিয়ে অনেকটাই আরকিটেকচারাল ভিউ এবং গাছ-গাছালির সমারোহ দেখার জন্য এ জায়গাটি টুরিস্টদের আকর্ষণ করে। পার্কের আশপাশে নেপালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। বিশাল মাঠ, যেখানে দেখতে পেলাম নেপালি আর্মিদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে অনেকটা সময়ই ঘুরেফিরে দেখে নিলাম কাঠমান্ডু শহরটিকে।
রাতের বেলায়ই সিদ্ধান্ত নিলাম কাল নাগরকোট দেখব। কিভাবে কম খরচে যেতে পারি, তা জেনে নিলাম। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বাইরে এসে দর কষাকষি করে একটা ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম।
ওখান থেকেই হিমালয় দেখা যায়। সরু রাস্তা দিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে বেয়ে উপড়ে উঠতে হয়। মনে ভয়ও হচ্ছিল। গাড়ি একটু এদিক-সেদিক হয়ে গেলেই আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না! ওখানে মেঘের উপর থাকে পাহাড়। মানে পাহাড়ের নিচের অংশ হলো মেঘের নিচে, আর উপরের অংশ হলো মেঘের ওপরে! আর হিমালয়তো আছেই। মেঘ আর পাহাড়-মেঘ আর পাহাড়!
নাগরকোট টাওয়ার নামে একটা জায়গা আছে, ওখান পর্যন্ত যেতে হয়। উপরে একটা ছোট টাওয়ারের মতো আছে। ওটাতে দাঁড়িয়ে হিমালয় ভাল দেখা যায়। এখান থেকে হিমালয়ের চূঁড়া দেখা যায়। ভাবতেই অন্যরকম লাগছিলো। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতগুলোর একটি আমি নিজ চোখে তাকিয়ে দেখছি! দৃশ্যটা একদম ছবির মতো। ঠান্ডা ওখানে খুব একটা নেই। তবে এভারেস্ট দেখতে যেতে হবে আরো অনেকটা দূরে। অনেক সময় সেখানে অবস্থান করার পর দুপুরের দিকে ফিরে আসি কাঠমান্ডুতে। তাই ঘোরার মত হাতে এখনো অনেক সময় আছে।
গুগল থেকে খুঁজে বের করলাম নেপালের জাতীয় মিউজিয়াম। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলাম সেখানে। যাবার পর আমি অবাক, গতকাল আমি এর পাশ থেকে এসে গেছি শম্ভুনাথ মন্দির থেকে। কিন্তু ন্যাশনাল মিউজিয়াম পাশেই, তা জানা ছিল না। যা হোক, টিকেট সংগ্রহ করি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য টিকেটের মূল্য আলাদা।
জাতীয় জাদুঘর, ১৯৩৮ অবধি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। এটি ছিল অস্ত্রাগার সংগ্রহশালা এবং অস্ত্রের ভান্ডার। পাশাপাশি রয়েল পরিবার এবং প্রধানমন্ত্রীর একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। এটি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে ‘ছাউনি শিলখানা’ নামে পরিচিত ছিল।
১৯৪২ সালে এর নামকরণ করা হয় নেপাল জাদুঘর হিসাবে। এটি ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় জাদুঘর (রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা) নামে নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই জাদুঘরটি হাজার হাজার প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংগ্রহ করেছে এবং দখল করে আছে প্রাচীন নেপালি শিল্প, সংস্কৃতি, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলার ভান্ডার।
জাতীয় জাদুঘরের ঐতিহাসিক ভবন, যোদ্ধা, বৌদ্ধ জাতীয় শিল্প গ্যালারি এবং বৌদ্ধ আর্ট গ্যালারি নামে তিনটি প্রদর্শনী ভবন রয়েছে। এর সংগ্রহগুলি দর্শনার্থীদের নেপালি শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার এবং বিস্তারিত তথ্য দিয়ে থাকে।
ন্যাশনাল মিউজিয়ামের পাশে রয়েছে মিলিটারি মিউজিয়াম। যা ঘুরে আসা সম্ভব হয়নি সময়ের কারণে। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে হেঁটে চলে আসি আবার শম্ভুনাথ মন্দিরে, সেখানে কিছুটা সময় থেকে চলে যাই থামেলে।
হোটেলে একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় থামেলের পাশে বিগ বাজার মার্কেটে যাই। সেখানে কিছু কেনাকাটা ও কাঠমান্ডুর রাতের দৃশ্য উপভোগ করে চলে আসি হোটেলে, কারণ পরদিনই ফিরে আসতে হবে নিজ দেশে।
নেপালের ভাষা নেপালি, তবে অক্ষরগুলো অনেকটাই হিন্দির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এখানকার মানুষেরা ইংরেজি অনেক কম বুঝে এবং বলতে পারে, কিন্তু সেটার তুলনায় হিন্দি ভাষা আরও অনেক ভালো বুঝে এবং বলতে পারে। তাই অনেক সময়ই ইংরেজির থেকে হিন্দিতে কথা শুনতে হয় বেশি।
এখানকার খাবার অনেকটাই বাংলাদেশের মত, শুধু কিছু আইটেম এবং পরিবেশনের ভিন্নতা ছাড়া। পোশাকের দিক দিয়ে বলতে গেলে নেপালের ট্রেডিশনাল কিছু পোশাক রয়েছে, যা আমরা কম-বেশি সবাই দেখেছি। বাকি পোশাকগুলোও আমাদের মতই। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্মগুলোও বাংলাদেশিদের মত। কিছু নেপালি তাদের ট্রেডিশনাল টুপি পড়ে থাকে।
নেপালে যে জিনিসটা প্রথমেই চোখে পড়েছিল তা হচ্ছে, এখানে মোটরবাইকের প্রচলন খুব বেশি। রাস্তায় ঘুরলে অসংখ্য মোটরবাইক চোখে পড়বে সবার। শহরের রাস্তাঘাট বেশিরভাগই মোটামুটি চার লেনের, যাওয়ার ২ লেন, আসার ২ লেন।
কিছু জায়গায় ছোট ছোট রাস্তা আছে, বাংলাদেশের মত। জ্যাম ও অনেক রাস্তার হালও বাংলাদেশের মত, ভাঙাচোড়া। তবে যেটা অবাক করা ব্যাপার হলো, জ্যাম থাকুক, রাস্তা ফাঁকা থাকুক, মানুষে পরিপূর্ণ থাকুক, এখানকার ড্রাইভাররা কখনোই হর্ন বাজায় না! হর্ণ বাজানোতে সবারই যেন অনীহা!
নেপাল দেশ হিন্দুপ্রধান দেশ। বেশিরভাগ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে দোকানপাট, যানবাহন, কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় তারা কমবেশি ছোট ছোট মূর্তি রাখে। অর্থনীতির দিক দিয়ে এরা খুব বেশি স্বচ্ছল না হলেও তাদের আয়ের অনেকাংশই আসে ট্যুরিজম থেকে। খুবই অতিথিপরায়ণ এরা, ট্যুরিস্টদের খুব সম্মান দিতে জানে।
নেপালে খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো এখানকার নেপালি খাবার। পাশাপাশি সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়। যে যার পছন্দ অনুযায়ী সেগুলো খেতে পারে। রেস্টুরেন্টভিত্তিক এ মেন্যুর দাম বিভিন্ন হয়। নেপালে অনেক জায়গাতেই ১০% সার্ভিস চার্জ এবং ১৩% ভ্যাট রাখে, আবার অনেক জায়গাতে খালি সার্ভিস চার্জ রাখে, আবার কিছু জায়গাতে শুধু খাবারের দামই রাখে। এটা জায়গা এবং রেস্টুরেন্ট উপর ভিত্তি করে।
সবকিছু মিলে ভালো ছিল নেপাল ভ্রমণ। হাতে আরো সময় থাকলে হয়তো আরো অনেক জায়গা ঘুরে দেখা যেতো। সবকিছু উপভোগ করতে হলে সময় নিয়ে যেতে হবে।
পর্যটকদের প্রতি পরামর্শ রইলো যাবার আগে পরিকল্পনা সাজিয়ে নেবেন। আপনার ছুটি কতো দিনের, তার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিন। তিন-চার দিনের ছুটি হাতে নিয়ে গেলে আপনি শুধু ঘুরতে পারবেন কাঠমান্ডু এবং এর আশপাশের কিছু এলাকা। আর সাত বা আট দিন সময় পেলে পোখারা ও তার আশপাশের এলাকাগুলোও ঘোরার সুযোগ পাবেন।
যাঁরা এভারেস্ট বা অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে ট্রেকিংয়ের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা পরিকল্পনা। বলে রাখি, সুন্দর, আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য পূর্বপরিকল্পনা ভীষণ জরুরি।
ছবি লেখক – বিশেষ প্রতিনিধি, আমেরিকা নিউজ এজেন্সি (এনা)।