লাতুর ট্রেন, আমার “শৈশবের স্মৃতিচারণ”
প্রকাশিত হয়েছে : ২:৩৩:৫৫,অপরাহ্ন ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | সংবাদটি ২৫৮ বার পঠিত
মাহবুব আজমল দুখু ▪
পরিচিত জনের নাম শুনেই আন্দাজ করতে পারছেন আজ কি ব্যাপারে লিখবো! হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে আমার শৈশব স্মৃতি।
১৮৮৫ সালে কুলাউড়ার লাতু সীমান্ত দিয়ে চলা রেলগাড়ি যা লাতুর ট্রেইন নামেই পরিচিত ছিলো স্থানীয় সবার কাছে যা ২০০২ সালে রেলকর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। তখনকার সময়ের যাতায়াতের চরম দুর্ভোগে একমাত্র আশা ভরসা ছিলো এই লাতুর ট্রেন। যদিও খুবই ধীরগতিতে চলতো এবং নানা জঠিলতায় পরিপূর্ণ ছিলো- তাও লাতুর ট্রেনে জড়িয়ে আছে অনেক হাসি কান্নার গল্প। তার কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করবো লিখনীতে।
ভরদুপুরে মার্বেল খেলায় মগ্ন আমি, হঠাৎ সাজু আপু কানে কানে এসে বললেন, আম্মু কার কাছে যেনো গল্প করছেন যে আমরা আগামীকাল সিলেট যাবো। শুনার সাথে সাথে আমার সে কি উচ্ছ্বাস! খেলার জোশ যেন বেড়ে গেলো, সবাইকে হারিয়ে অনেকগুলো মার্বেল জিতে ঘরে ফিরলাম।
সময় যেন ফোরাচ্ছে না, কবে রাত পাড় হবে আর লাতুর ট্রেন চড়ে সিলেট যাবো!
কুলাউড়া- শাহবাজপুর রেললাইনের লাতুর ট্রেন ধরতে আমাদের প্রথমে যেতে হতো রিক্সায়। সুজানগরের উঁচুনিচু ককর্দমাক্ত রাস্তায় রিক্সা যেন চলতেই চায়না। বার বার রিক্সার চেইন চ্যুতি ঘটতো, এমনও হয়েছে ট্রেন আসার হুইশেল শুনে রিক্সা ছেড়ে হেঁটে শর্টকাট রাস্তায় রওনা হতাম ট্রেন ধরতে!! স্টেশনে পৌঁছে নাস্তার একমাত্র স্থান ছিলো দিলীপ দাদার “নিরামিষ রেস্টুরেন্ট”। দাদার কাছ থেকেই খবরা খবর পাওয়া যেতো কে শহরে গেলেন আর কে ফিরলেন শহর থেকে। তখন মোবাইল ছিলো কল্পনার বাইরে, দিলীপ দাদা ছিলেন এলাকার যোগাযোগের মাধ্যম।
নাস্তা শেষে ট্রেনে উঠে ট্রেইন ছাড়ার অপেক্ষা করতাম। অনেকসময় পাশের লাইনে থাকা ট্রেইন চললে মনে হতো আমি যেটায় বসে আছি সেই ট্রেন ই চলছে!
লাতুর ট্রেনে চড়তে কেউই টিকেট করতেন না। টিটি আসলেই হাতে দুই/পাঁচ টাকা ধরিয়ে দিলেই চলতো। কিন্তু যেদিন ” শামছুল টিটি” থাকতেন সেদিন কোনো দুর্নীতি চলতোনা, উনি খুবই কড়া এবং সৎ মানুষ ছিলেন। তাই প্রথমেই সবাই খোঁজ নিতেন যে আজ শমছু টিটির ডিউটি কিনা!
এরকম একজন সৎ নিষ্ঠাবান মানুষ নিরবেই চলে গেলেন, কতজন ই বা মনে রেখেছে উনার কথা।
ট্রেইনের জরাজীর্ণ দেহকে মানুষ কত যে পরম যত্নে ব্যবহার করতো! প্রায় বগীতেই ফ্যান থাকতো না, ইমার্জেন্সি চেইন নস্ট ঝংধরা। প্রত্যেক বগিই আলাদা, এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়া যেতোনা।
ট্রেনে উঠতেন বিভিন্ন রকম যাত্রী, একেকজনের উদ্দেশ্য যেমন ভিন্ন তেমনই গন্তব্য ও ছিলো ভিন্ন। ঠিক যেনো পুরো জীবনের ই ছোট্ট একটি প্রতিফলন এক একটি ট্রেন যাত্রা।
যাত্রার প্রারম্ভে একজন চিল্লাইয়া আজকের বাংলা ইংরেজি সবগুলো সংবাদপত্রের শিরোনাম মুখস্থ বলে যেতেন। বলছিলাম হাশিম ভাইয়ের কথা, উনার চোখ কানা ছিলো তবে কন্ঠস্বরের মাধুর্যে মুগ্ধ করে যাত্রীর থেকে পয়সা ইনকাম করতেন।
প্রায়ই তিনি গাইতেন…
“আল্লাহু আল্লাহু, তুমি জাল্লেজালালুহু।
শেষ করা তো যায়না গেয়ে তোমার গুনগান”
তারপর গাইতেন…
“ও জানেওয়ালে বাবু
একটা পয়সা দে না!
অনেকে খুশি হয়ে দু-এক পয়সা দিতো।
চানাচুর নিয়ে হাজির হতেন আরেকজন আলতাই নামের। যদিও বর্তমানে ট্রেইনযাত্রায় হিজরাদের উপদ্রবের মতো বিড়ম্বনা তখনকার সময়ে ছিলো না, তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা পকেটমারের ঘটনা ঘটতো। পকেটমার ও ছিলো চেনাজানা- ম**নু রেডিও নামে ডাকা হতো এক পকেটমারকে, যে প্রায়ই ধরা খেতো।
যাত্রা শুরু হওয়ার আয়োজন ও ছিলো উপভোগ্য। একজন হুইশেল বাজিয়ে জানান দিতেন চালককে, ইঞ্জিনের স্টার্ট নেওয়ার আওয়াজ ও ছিলো ঝকঝকাঝক মনে রাখার মতো। ট্রেইন চলা শুরু করলে আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে গাছপালা আর প্রকৃতির দ্রুত পিছনে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করতাম।
বেশিরভাগ যাত্রী ব্যবসার কাজে বা আত্মীয়ের বাসায় বেড়ানোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। তবে কিছু ভিন্নরকম যাত্রীও চোখে পড়তো যেমন একদল তরুণ দলবেঁধে ট্রেইনে উঠতেন সিলেটে সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে কিন্তু বাসায় বলে এসেছেন কুলাউড়া ওয়াজমাহফিলে যাবেন!
অনেকে আবার ভবঘুরে টাইপের, ট্রেনে উঠে খুঁজতেন শাহরুখ- কাজলের মত জীবনসাথী। হয়তো পেয়েও যেতেন কিন্তু চোখাচোখির সীমানা ছাড়ায়ে প্রেমপত্র নিবেদন বা ঠিকানা যোগাড় করার সাহস হতোনা বিধায় কতশত ভালোবাসার ছোটগল্প ট্রেনের এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনেই সমাপ্তি ঘটতো।
জুড়ী দক্ষিণভাগ কাঁঠালতলী বড়লেখা মুড়াউল শাহবাজপুর পাড়ি দিয়ে যখন মোগলাবাজার কটালপুর আসতাম তখন কাজিটুলা টিভি স্টেশনের সিগনাল লাইট দেখেই বুঝে ফেলতাম যাত্রা অবসানের পথে, সিলেট আর বেশি দূরে নেই। আনন্দে উচ্ছ্বাসে শিশুমনে আমার খুশির ঢেউ খেলতো।
অবশেষে ট্রেন থেকে নেমে আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছতাম, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আবারও চড়ে বেড়াতাম লাতু ট্রেনের একবগী থেকে আরেক বগি।
এখনো স্বদেশে ফিরে গেলে খুঁজে বেড়াই শৈশবের লাতুর ট্রেন। জানিনা কবে চালু হবে আর চালু হলেও আগের সেই স্বাদ অনুভূতি ফিরে পাবো কিনা!
এখনো ভাবি- কুলাউড়া-শাহবাজপুর লাতুর ট্রেন চালু হবে তো! আবার ঘুম ভাঙাবে কী ‘লাতুর ট্রেন’ ?
২০০২ সালে কুলাউড়া- শাহবাজপুর লাইনে রেল চলাচল বন্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় রেললাইনটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু শুরু হয়নি কাজ। সর্বশেষ ২০১৫ সালে একনেকের বৈঠকে ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা অনুমোদন পায়।
এ খবরে বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া ও সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষের মনে নতুন করে আশার আলো জাগে। কিন্তু একনেকে বিল পাস হওয়ার প্রায় ৫ বছর অতিবাহিত হলেও অদ্যাবধি এ রেললাইনটির সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। এতে চার উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আবারও যেনো নতুন প্রজন্মের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় পুরনো সেই লাতুর ট্রেন।
লেখকঃ আমেরিকা প্রবাসী। সাবেক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক (সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদ ৮৭-৮৮)।