জালালি কৈতর : এখন আর ঝাঁকে উড়ে না
প্রকাশিত হয়েছে : ১:১৯:৪৯,অপরাহ্ন ২৭ অক্টোবর ২০২০ | সংবাদটি ৯৯ বার পঠিত
আবদুল হামিদ মানিক:
জালালি কবুতর সিলেটের প্রধান আকর্ষণ। মহান দরবেশ হজরত শাহজালালের স্মৃতি বিজড়িত এই কবুতরগুলো নীল আকাশে পাখনা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায়। দালানের ছাদে, ঘরবাড়ির ফাঁক ফোকড়ে যখন তখন বাক বাকুম সুর তোলে। অন্য পাখির মতো এতটা ভয়কাতর নয়, অনেকটা মানুষঘেঁষা। তাই পাশে থেকে এদের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় সকলের। সুন্দর, নিরীহ, নির্দোষ এই কবুতরগুলোর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
জালালি কবুতর স্বতন্ত্র প্রজাতির না-হলেও এর বৈশিষ্ট্য আছে। অন্যান্য দেশে প্রায় একই রঙের যে কবুতর দেখা যায়, জালালি কবুতর আকারে তার চেয়ে সামান্য ছোট। রঙেও কিঞ্চিৎ তারতম্য আছে। জালালি কবুতর এর রঙ সুরমার মতো, ঠিক আকাশি নীল নয়। মনোহর এই কবুতরগুলো হজরত শাহজালালের স্মৃতির সঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জড়িয়ে আছে।
হজরত শাহজালালের জীবনীকারদের প্রায় সবাই কবুতর সম্পর্কে একটি কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সিলেটের পথে হজরত শাহজালাল দিল্লিতে অবস্থান করেন। সাক্ষাৎ হয় বিখ্যাত সাধক নিজামউদ্দিন-এর সঙ্গে। তিনি একজোড়া কবুতর উপহার দেন হজরত শাহজালালকে। সিলেটে ওই কবুতরই জালালি কবুতর রূপে যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আসছে।
এ কাহিনীটি জনপ্রিয় এবং বহুশ্রুত। তাই প্রথম থেকেই জালালি কবুতরের প্রতি সিলেটবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি শ্রদ্ধাপূর্ণ। এ কবুতর শিকার করা, ধরে বিক্রি করা বা খাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারে না। ভয়ে অথবা শ্রদ্ধায় কবুতরগুলোকে কেউ উত্যক্ত করে না। লোকবিশ্বাস, যার বাড়িতে এরা বাসা বাঁধে তার মঙ্গল হয়। এক সময় সিলেটের অনেক বাড়িতে চাল অথবা ছাদে দেখা যেত কলসি ঝুলানো। কেউ কাঠের তৈরি কুঠুরিও বানিয়ে রাখতেন। কবুতর এতে বাসা বাঁধতো। এরা খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায় না। যেকোনো ঘরের ছাদ বা চালের একটু ফাঁক ফোকড় হলেই রাত কাটিয়ে দেয়। দিন হলে পাখা মেলে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অগ্রহায়ণ পৌষ মাসে ধানের মাঠে, গোলায় দেখা যেত ঝাক ঝাক কবুতর। কিন্তু ইদানীং কবুতরের ঝাঁক আর আগের মতো চোখে পড়ে না।
এক সময় সিলেটের ক্বিনব্রিজ ছিল হাজার হাজার কবুতরের রাতের আশ্রয়। সন্ধ্যা হতেই বাতাসে ডিগবাজি খেতে খেতে এরা দলে দলে উড়ে আসত ব্রিজের বুকে। ব্রিজের পিঞ্জিরাসহ উপরের দিকে গা ঘেঁষাঘেষি করে বসত। সন্ধ্যায় পথচারীরা ব্রিজ পার হতে গিয়ে নিদেনপক্ষে হাতের কাগজ দিয়ে মাথা ঢাকতেন। প্রতিদিন সকালে ব্রিজের উপর বিষ্ঠার স্তর পড়ে যেত। পরিষ্কার করতে হতো কোদাল দিয়ে। তাদের মূল আস্তানা দরগাহ এলাকা হলেও বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্র ছিল আনাগোনা। দরগা চত্বরে দেয়ালঘেরা পাকা একখ- মাঠের মতো স্থান আছে, লোকজন ধান ছড়িয়ে দিতেন ওখানে। ওই স্থানে এখন কবুতরের ভিড় নেই।
জালালি কৈতর সিলেটের আকাশে ওড়ে নীলপাখা মেলে। দৃশ্যটি যেমন সুন্দর তেমনই ছিল আলাদা স্মৃতিময় ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। তাই গানে কবিতায় এসেছে বার বার। কবি মুফাখখারুল ইসলাম জালালি কৈতর’ নামে একখানি কাব্যগ্রন্থও রচনা করেছেন। পায়রা শান্তি’র ও সৌন্দর্যের প্রতীক। এ হিসেবেও মানুষের সমাদর পায়।
নিসর্গের অনুষঙ্গ পাখপাখালি রক্ষায় এখন সরকারও সচেষ্ট। সব ধরনের পাখি শিকার আইনসম্মত নয়। তারপরও জালালি কবুতর কমে আসছে। অমনিতেই অনেক প্রজাতির প্রাণী ও পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জালালি কবুতর রক্ষায় জনগণের সচেতনতা দরকার। জানা যায় কবুতরগুলো আজকাল স্থানে স্থানে নির্যাতনের শিকার হয়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন একবার পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জালালি কবুতর নিধন নিষিদ্ধ করেছেন এবং এই সুন্দর প্রজাতির কবুতর রক্ষায় জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন। শান্তির প্রতীক, ঐতিহাসিক স্মৃতিময় জালালি কবুতর সকলের সুচেতনায় নির্বিঘ্নে আকাশে বিচরণ করুক।